পল্লবীর গর্ব আসিফ ইকবাল

0
11
ছাত্র আন্দোলনে আসিফ ইকবাল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নগরীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা এমএ রাজ্জাক সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকাভিভূত ও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
দুই সন্তানের মধ্যে জনাব রাজ্জাকের বড় ও একমাত্র পুত্র আসিফ ইকবাল ১৯ জুলাই ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নগরীর মিরপুর ১০নম্বর এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ২৯ বছর।
রাজ্জাক একটি পোশাক কারখানায় চাকরি শেষে তিন বছর আগে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। আসিফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি) থেকে ২০১৭ সালে ব্যাচেলর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিগ্রি শেষ করার পর তার তিন সদস্যের পরিবারকে সাহায্য করতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।শনিবার রাজধানীর মিরপুর এলাকায় তার পল্লবীর বাসায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেন, ‘আমার ছেলেই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আমরা এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি।’ 
কয়েক বছর আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন রাজ্জাকের স্ত্রীসহ দুই সদস্যের পরিবার। 
আসিফের বাবা বলেন, তার ছেলেটি ছিলেন অত্যন্ত সহৃদয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো মূল্যে অন্যদের সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। একজন ক্রীড়াপ্রেমীও ছিলেন আসিফ।
কান্না-জড়ানো কণ্ঠে রাজ্জাক বলেন, আসিফ রক্তদান করতেন ও অন্যদেরও রক্তদানে উৎসাহিত করতেন। ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল তার সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জাতির সেবার লক্ষ্যে একজন বিজনেস আইকন হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কিন্তু, একটা বুলেট তার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।’ 
আসিফ যেদিন শাহাদাত বরণ করেন, সেদিন আন্দোলনে তার সঙ্গী ছিলেন তার মামাতো ভাই মো. রাশিদুল হাসান। তারা এক অপরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অবসর সময় একসাথে কাটাতেন। 


ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাশিদুল বলেন, ১৯ জুলাই (শুক্রবার) তারা শেখপাড়া এলাকার বায়তুল দারার মসজিদে একসঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করেন এবং মসজিদের সামনের ঈদগাহ মাঠে আধা ঘণ্টা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। 
এরপর তারা বের হয়ে মিরপুর-১০ মোড়ে যাচ্ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু পথে আসিফ তৃষ্ণার্ত হওয়ায় পানি খেতে চান।
রাশিদুল বলেন, ‘তাই, আমরা আদর্শ স্কুলের কাছে স্বপ্ন সুপার শপে কিছু বিস্কুট কিনতে যাই এবং স্কুলের সামনে এক বিক্রেতার কাছ থেকে আখের রস খাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আখের রস খেয়ে মিরপুর-১০ মোড়ের দিকে যাওয়ার সময়  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তখন সেখানে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি তেমন ছিল না।
রাশিদুল বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের তুলনায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশি।
আসিফের জনগণকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ গুণ ছিল উল্লেখ করে রাশিদুল বলেন, আসিফ এক পর্যায়ে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিলে আমরা একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হই। তখন আ. লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিরপুর ১০ মেট্রো স্টেশনের দিকে হটে যেতে বাধ্য হয়।
জনতার ধাওয়া খেয়ে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মিরপুর-৬-এর পাশে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে অবস্থান নেয়। পরে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে এবং আ.লীগ নেতারা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
আসিফের চাচাতো ভাই বলেন, ‘আমরাও পাল্টা তাদের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করি। তবে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আমরা পেছন থেকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। কাজীপাড়া থেকে ২০-২২টি মোটরসাইকেলের একটি বহর নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে গুলি ছুড়তে দেখি। পরে তাদেরকে মিরপুর-১৩-এর দিকে চলে যেতে দেখি।’
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেওড়াপাড়া এলাকার কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ জনি মোটর শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন এবং এ ঘটনায় অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
রাশেদুল জানান, এক পর্যায়ে তারা দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রাশিদুলকে পাঠিয়ে দিয়ে আসিফ ঘটনাস্থলেই থেকে যান।
এ সময় স্কুলের বড় ভাই আরিফ আসিফের সঙ্গে ছিলেন।
আরিফ জানান, মিরপুর-১০ মোড়ে শাহ আলী মার্কেটের বিপরীত পাশে তারা বিক্ষোভ করছিলেন। এ সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন নির্বিচারে গুলি চালায়। এক পর্যায়ে তারা একটি গলিতে ঢুকে পড়েন। নিরাপদ স্থানের খোঁজে ফুটপাতের একটি দোকানের পাশে লুকানোর চেষ্টা করেন আসিফ। 


তিনি বলেন, ‘এর পরপরই আমরা সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে দিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই এবং আসিফকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই।’ 
আসিফকে নিকটবর্তী আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করে। 
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অধীনে সন্ত্রাসবিরোধী সহায়তা (এটিএ) প্রকল্পে দোভাষী দলের নেতা ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োজিত আসিফের চাচাতো ভাই রাশিদুল বলেন সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে তিনি একটি ফোন পান ও জানতে পারেন, আসিফকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অপারেশনের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন ‘আমি হাসপাতালে পৌঁছার আগে আরেকটি কল পাই। এর মাধ্যমে আমি নিশ্চিত হই যে আমার ভাই আর নেই।’ 
রাশিদুল জানান, ৭.৬২ মিলিমিটার বুলেটের আঘাতে হার্টের ডান পাশের প্রধান ধমনী ছিঁড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আসিফের মৃত্যু হয়।
আসিফের শরীরে প্রাপ্ত বুলেট সম্পর্কে একজন গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি একটি দক্ষ স্নাইপারের কাজ এবং কমপক্ষে ৩০০-৪০০ মিটার দূর থেকে তাকে টার্গেট করে গুলি চালানো হয়েছিল।আসিফের নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পর্কে রাশিদুল বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনেও তিনি (আসিফ) দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাশিদুল একটি ছবি দেখান যেখানে আসিফ হ্যান্ডমাইক হাতে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শত শত শিক্ষার্থী তার পিছনে মিছিল করছে।
আসিফকে ২০ জুলাই মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শনিবার পল্লবী আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয়রা তাদের লেনের একটি স্থানকে ‘শহীদ আসিফ চত্বর’ নামকরণ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেয়ালে গ্রাফিতিতে আসিফের ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে।   
আসিফ হত্যার বিচার চেয়ে কার বাবা রাজ্জাক বলেন, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে প্রায় ৫০০ জনকে আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থায় একটি মামলা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না। এখন আমরা শুধু বিচার চাই। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের ফাঁসি চাই।’